শনিবার, ২০ আগস্ট, ২০১১

ইসলামী ব্যাংকিং প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ



মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
ছাত্র, ইফতা বিভাগ, মা‘হাদুল ইকতিসাদ




একটি অর্থনীতিকে সচল রাখতে ব্যাংকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ব্যাংক হলো অর্থের ব্যবসায়ী। সুতরাং অর্থ এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থা এমন রূপ ধারণ করেছে যে, একটি ছাড়া আরেকটি চিন্তা করাও যায় না। ব্যাংক বর্তমানে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে অর্থের প্রচলন ঘটায়, নোট ইস্যু করে তাই অর্থ এবং ব্যাংক যেন একে অপরের পরিপূরক। তাই অনেক বিশেষজ্ঞ বলে থাকেনÑ “অর্থ হলো ব্যাংকের জন্মদাতা আর ব্যাংক হলো অর্থের সংরক্ষক”। 
বর্তমানের আধুনিক ব্যাংকিংব্যবস্থা একদিনের ফসল নয়। কালের স্রোতে, মানুষের প্রয়োজনে ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপকতার  ফলে ও অর্থ নিরাপদে রাখার প্রয়োজনে ব্যাংক ব্যবসায়ের উৎপত্তি ঘটে। প্রথমে ভাগের সুবিধার জন্য বিনিময়প্রথা প্রবর্তন হয়। পরে বিনিময় প্রথার অসুবিধার জন্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। আর যখন থেকে মুদ্রার প্রচলন শুরু হয় তখন থেকে ক্রমান্বয়ে ব্যাংকব্যবস্থাও সাংগঠনিক রূপ লাভ করে। তাই বিনিময় প্রথা, অর্থ ও ব্যাংকের মধ্যে একটি পারস্পরিক ক্রমধারা বজায় রয়েছে। প্রাচীনকালে মানুষ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠানের সততা ও নিষ্ঠার কারণে সেখানে টাকা জমা রাখতো ও প্রয়োজনের সময় ফেরত নিতো। এরপর মানুষ স্বর্ণকার, মহাজনদের কাছে বিভিন্ন শর্তে টাকা জমা রাখে। স্বল্প সুদে টাকা জমা রাখা, জমাকৃত টাকা চড়া সুদে অন্যকে ঋণ দেয়া যখন একটি ব্যবসা হিসেবে পরিগণিত হলো তখনই ব্যাংকব্যবস্থা ব্যক্তি পর্যায়ে না থেকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করতে থাকে। ব্যাংকব্যবস্থা প্রথম পর্যায়ে একক মালিকানা ভিত্তিতে থাকলেও পরবর্তীতে অংশিদারী ও যৌথ মূলধনী কারবার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
এরপর রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সরকারগুলো যখন দেখতে পায় যে, অর্থের মাধ্যমেই ব্যাবসায়ীরা দেশকে নিয়ন্ত্রণ করছে তখন সরকারগুলো এই অর্থব্যবস্থা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্দেশ্যে নোট ও মুদ্রার প্রচলন করে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার অর্থ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হাতে তুলে নেয়। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যতোই বৃদ্ধি পাবে ব্যাংকিং কার্যক্রমের গতিশীলতাও ততো বৃদ্ধি পাবে। 
১৪০০ খিষ্টাব্দের পর হতেই সত্যিকার অর্থে ব্যাংকের আধুনিক যুগ আরম্ভ হয়। এ সময়ের পর থেকে আধুনিক ব্যাংকিংব্যবস্থার ছোঁয়া অনুভূত হয়। যুগের ক্রমধারায় ব্যাংকব্যবস্থা বিভিন্ন ধারা অতিক্রম করে বর্তমান আধুনিক রূপ লাভ করেছে। চীনে খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দে বিশ্বের প্রথম ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। তার নাম শান্সী ব্যাংক (ংযধহংর নধহশ)। আর বিশ্বের প্রথম সনদপ্রাপ্ত ব্যাংক হচ্ছে রিকস্ ব্যাংক অব সুইডেন (জরশং নধহশ ড়ভ ঝবিফবহ) এটি সুইডেনে ১৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়।
ব্যাংক কাকে বলে (ডযধঃ রং নধহশ)? অর্থ নিরাপদে সংরক্ষণ, নগদ লেনদেনের ঝামেলা হ্রাস এবং অর্থের গতিশীলতা বৃদ্ধি করার জন্যই মূলতঃ ব্যাংকের উৎপত্তি হয়।
ব্যাংকের দুটি জনপ্রিয় সংজ্ঞা
১. অধ্যাপক সেয়ার্স (ঝধুবৎং) এর মতে “ব্যাংক এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার ঋণ সংশ্লিষ্ট অন্য সকলের পারস্পরিক ঋণ নিষ্পত্তির জন্য সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়”। ২.বাংলাদেশের প্রচলিত ১৯৯৪ সালের  কোম্পানি আইন অনুযায়ী যে প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ হলো চলতি বা অন্যকোনো হিসাবের মাধ্যমে জনগণের নিকট হতে টাকা আমানত গ্রহণ করা এবং চেক বা আদেশ পত্রের মাধ্যমে উক্ত টাকা উত্তোলনের সুযোগ প্রদান করা তাকেই ব্যাংকিং কোম্পানি বলে।  
ইসলামী ব্যাংক ব্যাবস্থার সূচনা
মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন ও বায়তুলমাল ঘোষণার মধ্যদিয়ে ইসলামে রাষ্ট্রীয় সম্পদ সংরক্ষণব্যবস্থার সূচনা হয়। হযরত আবু বকর রা.-এর আমলে হযরত আবু উবায়দা রা.-কে বায়তুলমালের পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। হযরত উমর রা.-এর যুগে বায়তুলমালে প্রাচুর্য দেখা দেয়। ব্যাংক ও ব্যাংকিং কার্যক্রমের অনেক কিছুই সেই বায়তুলমাল থেকেই আন্জাম দেয়া হতো। বায়তুলমাল বলতে গেলে তখন রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব পালন করতো।
দায়িত্বগুলো যথাক্রমে ছিলো এরকমÑ *রাষ্ট্রীয় সম্পদ বায়তুলমালে সংরক্ষিত রাখা। *মুদ্রা প্রচলন ও মুদ্রা প্রচলনের মন্জুরী দান এবং মুদ্রামান নিয়ন্ত্রণ করা। *জনগণের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। *বিনা সুদে ঋণ দান করা। *উৎপাদনী ব্যবসায় ঋণ সরবরাহ করা। 
এসকল কাজ হযরত উমর রা.-এর আমলে বায়তুলমাল থেকে আন্জাম দেয়া হতো। অবশ্য ঋণ নিয়ে তদ্বারা উপকৃত হওয়ার বা অর্থ সম্পদ কামানোর যে মন মানসিকতা থেকে আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার সূত্রপাত হয়েছে, ইসলাম সেই মানসিকতাকে স্বমূলে উচ্ছেদ করার সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়েছে। কাজেই আধুনিক ব্যাংকিংয়ের কোনো সূত্র ইসলামের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটি মূলতঃ ইসলামের ব্যর্থতা নয় বরং নিজস্ব স্বকীয়তার উপর ঠিক থাকার উদ্যোগ। সমাজের মানুষের জীবন নির্বাহের জন্য সাময়িক ঋণ প্রয়োজন রয়েছে। এ প্রয়োজনের কথা ইসলাম কেবল স্বীকারই করেনি বরং এধরনের প্রয়োজনে একে অপরকে ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য ইসলাম ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করেছে এবং এমন ব্যক্তিদেরকে ঋণ দিয়ে সহায়তা করাকে ইবাদতের মর্যাদা দিয়েছে। এ ধরনের ঋণদানকে কুরআনে আল্লাহকে ঋণদানের সমার্থক বলে আখ্যায়িত করে তার প্রতিদান হিসেবে দ্বিগুণ পুরস্কারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে।
 [সূরা হাদীদ, আয়াত : ১১]  من ذالذى يقرض الله قرضا حسنا فيضاعفه له
সুতরাং ঋণ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সারা বিশ্বে ইসলামের নবজাগরণ শুরু হয়। এসময় মুসলমানদের মাঝে সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয়। কিন্তু ততোদিনে সুদভিত্তিক ব্যাংকব্যবস্থা সারা বিশ্বকে এমনভাবে গ্রাস করে নেয় যে, সুদের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সুদের এই সর্বগ্রাসী থাবা থেকে বেরিয়ে আসার চেতনা থেকেই সুদমুক্ত ব্যাংক গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয় এবং বিশ্বব্যাপী এর চিন্তা-ভাবনা চলতে থাকে। সে চিন্তার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ মিশরের অধিবাসী আল্লামা আহমাদ আন-নাগগারের প্রদত্ত রূপরেখোর উপর ভিত্তি করে ১৯৬০ সালে মিশরের মিটগামারে “সেভিংস ব্যাংক” নামে বিশ্বের সর্বপ্রথম ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৩-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত মোট নয়টি প্রতিষ্ঠান ইসলামী পদ্ধতির আলোকে মিশরে ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে। 
এসময় অনেক রাষ্ট্রপ্রধানই মুসলিম বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পৃথক ব্যাংকব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকেন। ফলে ১৯৭৪ সালে ও.আই.সি’র জিদ্দায় অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে এতদসংক্রান্ত রিপোর্টের উপর পর্যালোচনার পর ইসলামী নীতিমালার আলোকে একটি পৃথক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যার ফলস্বরূপ ১৯৭৫ সালে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (ও.উ.ই) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর প্রধান লক্ষ্য ছিলো ইসলামী দেশগুলোর মাঝে জোরালো অর্থনৈতিক বন্ধন সৃষ্টি করা। জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে ইসলামী নীতিমালার বাস্তবায়ন করা। আর মুসলিম দেশসমূহের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার লক্ষে কাজ করা। ও.উ.ই’র প্রচেষ্টায় মুসলিম দেশগুলোতে সুদমুক্ত ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপক তৎপরতা শুরু হয়। এরই ফলশ্র“তিতে দুবাই, কুয়েত, মিশর, জর্ডান, বাংলাদেশ, পাকিস্তানে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক 
এই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালের ৩০শে মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম শরীয়াভিত্তিক ব্যাংক হিসেবে ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ যাত্রা শুরু করে। সূচনার পর থেকে এদেশের ইসলামী ব্যাংকিং ক্রমান্নয়ে অগ্রগতি লাভ করেছে। যার ফলশ্র“তিতে বাংলাদেশে ৭টি ব্যাংক পূর্ণাঙ্গভাবে এবং ১১টি ব্যাংক আংশিকভাবে ইসলামী শরীয়াহ অনুসরণ করে কল্যাণমুখী ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারও এর অগ্রযাত্রায় সহযোগিতা করেছে। দেশের রাষ্ট্রয়াত্ত ৩টি বৃহৎ ব্যাংক, যথাক্রমে, সোনালী, জনতা, অগ্রণী এবং বেসরকারী খাতের বৃহত্তম পূবালী ব্যাংকও আংশিকভাবে ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। এমনিভাবে বিগত প্রায় ২৭/২৮ বছরে বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং নামক চারা গাছটি আজ এক বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। আন্তরিক সেবা, সুনাম-সুখ্যাতি, লভ্যাংশ রেমিট্যান্স সংগ্রহসহ সকল ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকিং এগিয়ে চলছে।
কিন্তু শরীয়তের  দৃষ্টিতে এর কার্যক্রম লক্ষ করলে কিছুটা হতাশ হতে হয়। এর জন্য আলেম সমাজ দায় এড়াতে পারবে না। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকলে অবস্থা আরো ভাল হতো। আলেমদের একটি দল এর নেতৃত্বে থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো ইসলামী ব্যাংক বিতর্কিত ব্যক্তিদের হাতে। একটি ইসলামী ব্যাংক আলেমদের দ্বারা কার্যক্রম শুরু করেছিলো। কিন্তু দেখা গেলো আলেমগণ এক্ষেত্রে অদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। কারণ এসব ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা প্রায় শূন্যের কোঠায়। অবশেষে বাধ্য হয়ে ওই ব্যাংক আলেমদের জন্য তার প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেয়। 
ইসলামী ব্যাংকিং বাস্তবায়নে প্রতিকুলতা ও আমাদের করণীয়
ইসলামী ব্যাংকিং বর্তমান যুগে একটি অনস্বীকার্য বাস্তব সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ক্রমান্নয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃহদায়তন পুঁজি নিয়ে নতুন নতুন ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। আধুনিক ব্যাংকও ইসলামী শরীয়াহভিত্তিক আলাদা শাখা ও অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার পরিধি কমপক্ষে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আশা করা যাচ্ছে যে, ইসলামী ব্যাংকসমূহের লেনদেন পৃথিবীর আর্থিক চুক্তির একটি বড় অংশকে পরিবেষ্টন করে নেবে। কিন্তু ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য তাদের ব্যাবসা-বাণিজ্যের পরিধি বিস্তৃত করার পূর্বে নিজেদের বিগত দু’দশকের কার্যক্রম সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ করা উচিত। কেননা প্রত্যেক নিত্যনতুন পদ্ধতির জন্য অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা অর্জন করা উচিত এবং স্বীয় কর্মকাণ্ডের উপর পুনর্বার দৃষ্টিপাত ও নিজেদের ত্র“টি-বিচ্যুতির বাস্তবসম্মতভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। যে সময় পর্যন্ত আমরা আমাদের ত্র“টি-বিচ্যুতি এবং ভালো-মন্দের পর্যলোচনা না করবো সে সময় পর্যন্ত আমরা পূর্ণ সফলতার দিকে অগ্রসর হওয়ার আশা করতে পারি না। তাই আমাদের উচিত হলো, পর্যালোচনা করে দেখা যে, আমরা কী পেলাম আর কী হারালাম?
ইসলামী ব্যাংকের এটা দীপ্তমান সাফল্য যে, তারা এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গঠন করে শরীয়তের অনুসরণের জন্য একটি বিরাট পথ সুগম করে দিয়েছে। সুদবিহীন অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হওয়া মুসলমানদের একটি সুন্দর স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকিং শুধুমাত্র একটি কাল্পনিক বিষয় ছিলো। যে বিষয় রচনা-প্রবন্ধের মাধ্যমে গবেষণা করা হতো এবং তার কোনো বাস্তবরূপ ছিলো না। এসব ইসলামী ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানই এ স্বপ্ন এবং কাল্পনিক বিষয়কে বাস্তবায়ন করে জীবন্ত ও বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারা একাজ এমন এক পরিবেশে করেছে, যে পরিবেশে এ দাবি করা হতো যে, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানই সুদবিহীন চলা সম্ভব নয়। মূলতঃ এটা ইসলামী ব্যাংকের অত্যন্ত দুঃসাহসী পদক্ষেপ ছিলো। তারা এ দৃঢ় সংকল্প নিয়ে অগ্রসর হয়েছে যে, তাদের যাবতীয় চুক্তি ইসলামী শরীয়তসম্মত হবে ও তাদের সকল কর্মকাণ্ড সুদের সাথে জড়িত হওয়া থেকে পবিত্র থাকবে। 
একথা অবশ্যই বুঝা উচিত যে, আমরা যখন বলি ইসলাম সর্বকালের সর্বাবস্থায় প্রত্যেক সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান পেশ করতে সক্ষম। তার অর্থ এটা নয় যে, কুরআন হাদীস এবং মুসলিম আলিমদের গবেষণাকৃত বিদি-বিধানে আমাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনের যাবতীয় বিষয়াদী বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। বরং উদ্দেশ্য হলো কুরআন এবং হাদীস বিস্তৃত এবং ব্যাপক মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। যেগুলোর আলোকে প্রত্যেক যুগের আলিমগণ তাদের যুগের নিত্য-নতুন সমস্যার সমাধান খুঁজে নিতে পারে। একারণেই শরীয়তের আলোকে ইসলামী অর্থনীতির সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য শরীয়তবিজ্ঞদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। তাদেরকে প্রতিটি সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে কুরআন হাদীসে নির্ধারিত নীতিমালা ও ইসলামী ফিকহের গ্রন্থাবলিতে বর্ণিত বিধি-বিধানের আলোকে গবেষণা করতে হয়। অধিকাংশ ইসলামী ব্যাংক শরীয়াহ সুপারভাইজারি বোর্ডের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। এসব ব্যাংক তাদের দৈনন্দিন উদ্ভূত সমস্যাবলি শরীয়তবিজ্ঞদের সামনে পেশ করে, যারা ইসলামী নীতিমালা ও বিধি-বিধানের আলোকে তাদের সম্পর্কে বিশেষ আহকাম চালু করে। এ পদ্ধতি দ্বারা শুধু এতোটুকুই নয় যে, শরীয়তবিজ্ঞ নিত্য-নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করে বরং এসব আলেমগণের গবেষণার মাধ্যমে ইসলামী ফিকহেরও উত্থান হয়। সুতরাং কোনো কাজকে যদি শরীয়তবিজ্ঞরা অনৈসলামিক বলে সাব্যস্ত করেন, তাহলে আলেমগণ ও ইসলামী ব্যাংকসমূহের ব্যবস্থাপকদের যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সেগুলোর উপযুক্ত বিকল্প পন্থাও অনুসন্ধান করা হয়। 
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, ইসলামী ব্যাংকিংব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা সহজ কোনো বিষয় নয় বরং তা একটি দুরূহ কাজ। এক্ষেত্রে অনেক প্রতিকূলতা রয়েছে। আর একারণেই এই সেক্টরে ত্র“টি-বিচ্যুতি থাকা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আমাদের উচিত হলো, ত্র“টি-বিচ্যুতিগুলো দূরীভূত করার ব্যবস্থা করা। এর জন্য যা যা করার দরকার তার সবই করা। এটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ভুল-ভ্রান্তি দেখে যদি আমরা মুখ ফিরিয়ে নিই তা হবে নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। কেননা ব্যাংকিংব্যবস্থা বর্তমানে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এটা ব্যাতীত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কল্পনাও করা যায় না।  
উলামায়ে কেরামের করণীয়
এসব সমস্যা সমাধানে সর্বাগ্রে উলামায়ে কেরামকে এগিয়ে আসতে হবে। আল্লাহর মেহেরবানিতে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং দ্রুত বিকাশ লাভ করছে। ইসলামী ব্যাংকের শাখা, জনশক্তি, ডিপোজিট, ইনভেস্টমেন্ট সবই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে হারে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে সে হারে সেগুলোকে সঠিক নির্দেশনা দেবার জন্য ফিকহুল মুআমালাতে বিশেষজ্ঞ ফক্বীহ বা আলেম তৈরি হচ্ছে না। যা এ শিল্পের জন্য মোটেই সুসংবাদ নয়। বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিংকে সঠিক মানে পরিচালনার দিক-নির্দেশনা প্রদানে আলেমগণকে সক্ষম ও দক্ষ ইসলামী অর্থবিশেষজ্ঞ হিসেবে গড়ে তোলা আবশ্যক। এজন্য বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে। 
ইসলামী ব্যাংকিংয়ে উলামায়ে কেরাম কতৃক অনুমোদিত যেসকল পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে তা শতভাগ ইসলামী ও শরীয়াসম্মত হতে হবে। শরীয়াসম্মত হওয়ার ক্ষেত্রে মুহাক্কিক আলেমগণ বিস্তারিত বর্ণনাসহ এসকল পদ্ধতির জন্য প্রযোজ্য শর্তসমূহ নির্ধারণ করে দেবেন। শরীয়াসম্মত এ পদ্ধতিসমূহের বাস্তব প্রয়োগে যদি কোনো ব্যাংক বা কর্মকর্তা শিথিলতা প্রদর্শন করেন অথবা শরীয়াহ লংঘন করেন তাহলে সেটা ইসলামী ব্যংকিংয়ের কোনো দোষ বা ত্র“টি নয় বরং তার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা কর্মকর্তা আল্লাহর কাছে দায়ী থাকবেন। আর এজন্য যারা গোটা ইসলামী ব্যাংকিং সিস্টেমকে প্রশ্নের সম্মুখীন করবেন তারাও আল্লাহর কাছে দায়ী থাকবেন। 
প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকিং সিস্টেমে কোনো ত্র“টি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হলে তা সংশোধনের জন্য আলেমগণসহ সকলকে যথার্থ ভূমিকা পালন করতে হবে। ইসলামের স্বার্থে বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিংয়ের উন্নয়ন অগ্রগতি এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে আলেমগণকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্যথায় ইসলামী ব্যাংকে শুধু ইসলামের লেভেল বহাল থাকবে। 
সুদমুক্ত ইসলামী ব্যাংকিং এখন একটি সফল ও কল্যাণময় ব্যাংকিং সেবা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এর সফলতা শুধু মুসলিম বিশ্বকে নয় অমুসলিম বিশ্বকেও আকৃষ্ট করেছে। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অভাবিত সাফল্যের কারণে এর বিরুদ্ধে সম্ভাব্য শত্র“তা ও আঘাত থেকে বাঁচতে আমাদের সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এজন্য ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত আলেমগণ বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন। মনে রাখতে হবে, সুদ সমাজের সবচেয়ে বড় শোষণের হাতিয়ার। সুদের মাধ্যমে সমাজকে সবচেয়ে সুকৌশলে বেশি শোষণ করছে আজকের সনাতনী ব্যাংক ব্যবস্থা। কি পুঁজিবাদী দেশ, কি সমাজতন্ত্রী দেশ, কি মুসলিম দেশÑ সর্বত্রই সনাতনী ব্যাংকগুলো সুদী কারবারে লিপ্ত। কেউ সুদ থেকে বাঁচতে পারছে না। এমনকি যারা শুধু নিরাপত্তা সঞ্চয়ের জন্যই ব্যাংকে টাকা আমানত রাখে তাদেরও মুনাফার 
লেবাস পরিয়ে ব্যাংক সুদ নিতে প্ররোচিত করে। সমাজ বিধ্বংসী শোষণের সফল মাধ্যম এই সুদের হাত থেকে মুসলিম মিল্লাতকে রক্ষা করার জন্যই বর্তমানকালে সৃষ্টি হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের। ইসলামী ব্যাংক তাই মুসলিমদের জন্য শুধু প্রয়োজনীয় এক প্রতিষ্ঠানই নয় বরং তা মুসলিম উম্মাহর জন্য অপরিহার্য এক ইন্সটিটিউশন।
শেষ কথা হলো, ইসলামী ব্যাংকসমূহকে তাদের একটি পৃথক কালচার গঠন করা উচিত। স্পষ্টত যে, ইসলামী ব্যাংকিং চুক্তি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়, বরং ইসলাম উসুল ও বিধি-বিধানের এমন একটি সংক্ষিপ্তসার ধর্ম যা মানুষের পূর্ণ জীবনকে পরিবেষ্টন করে নিয়েছে। একারণে ইসলামী হওয়ার জন্য শুধুমাত্র ইসলামী নীতিমালার উপর প্রতিষ্ঠিত চুক্তিসমূহ ডিজাইন করে নেয়াই যথেষ্ট নয় বরং এটাও অপরিহার্য যে, প্রতিষ্ঠানের রীতি-নীতি এবং তার কর্মকর্তা কর্মচারীদের থেকে ইসলামী স্বকীয়তার নিদর্শন প্রকাশিত হতে হবে। যার ফলে তারা প্রচলিত প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বিশিষ্ট ও বিখ্যাত হবেন। এর জন্য প্রতিষ্ঠান এবং তার ব্যবস্থাপকদের সার্বিক কার্যক্রমে পরিবর্তন অপরিহার্য। 
এ কথার উদ্দেশ্য বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকসমূহকে নিরুৎসাহিত করা কিংবা তাদের ত্র“টি-বিচ্যুতি অনুসন্ধান করা নয়, বরং উদ্দেশ্য শুধুমাত্র তাদেরকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা যে, তারা যেন তাদের কার্যক্রমকে শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করে এবং নিজেদের কর্মপদ্ধতির গঠন ও পলিসি নির্ধারণে বাস্তবসম্মত চিন্তা-ভাবনা ও বিবেচনা করে।
তথ্যসূত্র :
ইসলামী ব্যাংকিং ও অর্থায়ন পদ্ধতি : মুফতী তাকী উসমানী
হামারা মাআশী নেযাম : মুফতী তাকী উসমানী
ইসলামী অর্থনীতির আধুনিক রূপায়ন : আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া
ইসলামী ব্যাংকিং : বৈশিষ্ট ও কর্মপদ্ধতি : শাহ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
একাউন্টিং ও কমার্স : একাদশ শ্রেণীর পাঠ্যবই

ফতোয়া প্রদানের মূলনীতি



মুফতী মুহাম্মদ আতিকুর রহমান
ছাত্র, ইফতা বিভাগ, মা‘হাদুল ইকতিসাদ ওয়াল ফিকহিল ইসলামী





ইসলামে ফতোয়া প্রদানের যেমন গুরুত্ব ও মর্যাদা রয়েছে তেমনি ঝুঁকিও রয়েছে অপরিসীম। কেননা ফতোয়া প্রদানকারী প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে দ্বীন সংক্রান্ত বিষয়াদি বর্ণনা করে থাকেন, হালাল-হারাম ব্যক্ত করেন। তাই আমাদের পূর্বসূরীরা সহজে ফতোয়া প্রদানের কাজে জড়িত হতে চাইতেন না। আবার ইলম গোপন করার আশঙ্কা ও জবাবদিহিতার ভয়ে দূরেও থাকতে পারতেন না। 
ফতোয়া যে কারো পক্ষে প্রদান করা সম্ভব নয়। কুরআন, হাদীস ও ফিকহে ইসলামীর যথেষ্ট জ্ঞান না থাকলে এ কাজ করা যায় না। তাছাড়া এ শাস্ত্রের ইমামগণ আরো কিছু শর্ত ও নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করেছেন যা একজন মুফতীকে অর্জন করতে হয়। বক্ষমান প্রবন্ধে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
ফতোয়া প্রদানের যোগ্যতা
যিনি ফতোয়া প্রদান করেন বা ফতোয়া প্রদানের কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাঁকে মুফতী বলা হয়। মুফতী হওয়ার জন্য অনেকগুলো শর্ত রয়েছে। ফিকাহ বিশারদগণ এসব শর্ত তাদের কিতাবাদিতে নির্ধারণ করেছেন। সেখান থেকে শর্তগুলো নিম্নে প্রদত্ত হলো।
প্রথম শর্ত : মুফতীকে মুসলিম হতে হবে। অমুসলিমের ফতোয়া প্রদান বৈধ নয়।
দ্বিতীয় শর্ত : তার (আকল) বিবেক-বুদ্ধি থাকতে হবে। পাগল বা মাতালের ফতোয়া প্রদান বৈধ নয়।
তৃতীয় শর্ত : বালেগ হতে হবে। না-বালেগের ফতোয়া গ্রহনযোগ্য নয়।
চতুর্থ শর্ত : মুফতীকে ন্যায়পরায়ণ, সুবিচারক এবং পুণ্যবান হতে হবে। ফাসেক পাপাচারীর ফতোয়া প্রদান বৈধ নয়।  
] مقدمة شرح المهذب  للنووي ١ : ٦٩ عن المصباح للمفتى كمال الدين احمدالراشدى  :٦١٧[   
পঞ্চম শর্ত : ফতোয়া প্রদানকারীকে খুব সচেতন ও বিচক্ষণ হতে হবে। মানুষের বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। কেননা কিছু লোক এমন আছে, যারা প্রতারণা ও ধোঁকার মাধ্যমে কথা পাল্টিয়ে দেয়াসহ ভ্রান্ত একটি বিষয়কে সত্য ও সঠিকের আবরণে উপস্থাপন করার যথেষ্ট যোগ্যতা রাখে। ফলে এ ক্ষেত্রে একজন মুফতীর অমনোযোগিতা ও অসচেতনতা বিরাট বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, ‘মুফতীর জন্য অবশ্যকর্তব্য হলো, মানুষের ধোঁকা, প্রতারণা এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হওয়া। তা না হলে তিনি যেমন নিজে পথভ্রষ্ট হবেন তেমনি অন্যকেও পথভ্রষ্ট করবেন। একজন মুফতী যদি মানুষের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত না হন, তাহলে তার নিকট জালিম মজলুমের কিংবা মজলুম জালিমের আকৃতিতে প্রকাশ পেতে পারে। قيم  الجوزية ٤ :٢٠٥]  . إعلام الموقعين عن رب العالمين للامام  ابن ]
শহরবাসীদের বিভিন্ন আচার আচরণ, মতভেদ ও সামাজিক নিয়ম নীতির প্রতি সচেতন থাকাও একান্ত প্রয়োজন। ওলামায়ে কেরাম বলেন, من لم يعرف اهل زمانه فهو جاهل  ‘যেব্যক্তি তার যুগের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল নয় সে মূর্খ।’
এবিষয়ে কতিপয় উলামায়ে কেরাম সতর্কতামূলক অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, ‘মুফতী হতে হলে তাকে অবশ্যই ফতোয়া প্রার্থীর ভাষা ও শব্দচয়ন সম্পর্কে পারদর্শী হতে হবে। যাতে তিনি উল্টো কোনোকিছু বুঝে ফতোয়া না দেন। বিশেষ করে কসম ও স্বীকারোক্তির ভাষার ক্ষেত্রে।[ المجموع من شرح المهذب ١:١٤]   
ষষ্ঠ শর্ত : মুফতীর এমন যোগ্যতা (মালাকাহ) থাকতে হবে যাতে তিনি অতীত ও বর্তমান লিখিত দ্বীনি কিতাবসমূহ বুঝতে পারেন এবং এর থেকে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে ফতোয়াপ্রদানে সক্ষম হন।
উল্লেখ্য যে, ফতোয়া প্রদানের দায়িত্ব পালনের জন্য শুধু পাঠ্যতালিকাভূক্ত ফিকহের কিতাব পড়াই যথেষ্ট নয়, বরং ফতোয়া প্রদানের নিয়মনীতি সম্পর্কিত কিতাবাদি অধ্যয়ন করা, প্রচলিত প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য ফতোয়ার কিতাবসমূহ পাঠ করা এবং কোনো অভিজ্ঞ মুফতীর সাহচর্যে থেকে তার পথ-নির্দেশনা লাভ করা মুফতীর জন্য একান্ত প্রয়োজন।
এমনকি শুধু অভিজ্ঞ মুফতীর কাছে শিক্ষাগ্রহণ করলেই ফতোয়া প্রদানের দায়িত্ব পালনে সফলতা লাভ করা যায় না। যতোক্ষণ নিজের মধ্যে এমন দক্ষতা ও নৈপুণ্য সৃষ্টি না হয়, যা দ্বারা সে উসূলে আহকাম, ইল্লত ও মাসআলার কাওয়াইদ নির্দ্বিধায় অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। ফতোয়ার কাজে সার্বক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট থাকা ও ফতেয়ার বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা দ্বারাই এ গুণ অর্জিত হতে পারে।
[ملخص من المصباح ٣٤٧-٣٥٧ و آداب المفتي  ٩٧-١٠٤]  
সপ্তম শর্ত : মুফতীর জন্য আরেকটি শর্ত হলো, তাকে কোনো অভিজ্ঞ মুফতীর কাছ থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত হতে হবে। যেমন, ইমাম মালিক রহ. বলেন, ‘আমি ততোক্ষণ পর্যন্ত ফতোয়া প্রদানের কাজে নিয়োজিত হইনি যতোক্ষণ না আমাকে সত্তুরজন আলেম ফতোয়া প্রদানের অনুমতি প্রদান করেছে। 
[المجموع من شرح المهذب  ١ : ٦٩]
পরিশেষে, মুফতী হওয়ার জন্য স্বাধীন পুরুষ, কানে শোনা, চোখে দেখা, কথা বলতে পারা জরুরি নয়। ক্রীতদাস, নারী, বধির, অন্ধ ও বোবাও ফতোয়া দিতে পারেন যদি তারা লিখতে পারেন অথবা তাদের ইশারা ইঙ্গিত বুঝা যায়। 
[مقدمة شرح المهذب ١:٦٩] 
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. উল্লেখ করেন, ‘যিনি মুফতী হবেন অবশ্যই তাকে পাঁচটি গুণের অধিকারী হতে হবে। ১. তার বিশুদ্ধ নিয়ত থাকতে হবে। যদি নিয়াত ঠিক না হয় তাহলে সেখানে নূর আসে না। ২. তার ইলম, সহিষ্ণুতা, গাম্ভীর্য ও স্থিরতা থাকতে হবে। ৩. ইলমের মধ্যে গভীরতা ও শক্ত ভিত্তি থাকতে হবে। ৪. তার যথেষ্ট যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকতে হবে, যাতে তিনি অন্যের সাহায্য ছাড়াই সমাধান দিতে পারেন। ৫. মানুষের অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত থাকতে হবে। কারণ যারা মানুষের অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞ, তারাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফতোয়া প্রদানে ভুল করেন।’ [مقدمة شرح المهذب ١:٦٩] 
ফতোয়া প্রদানের আদবসমূহ
যিনি ফতোয়া প্রদান করবেন অবশ্যই তাকে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। তাহলেই কেবল তার ফতোয়া গ্রহণযোগ্য হবে।
ক. যিনি মুফতী হবেন তাঁর উচিত হবে শরীয়তের বিধানসমূহের প্রতি লক্ষ রেখে পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করা। তা সুন্দর রাখা এবং পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার উপর গুরুত্ব দেয়া। রেশমী কাপড়, স্বর্ণ এবং যেসকল পোশাকে অমুসলিমদের নিদর্শন রয়েছে তা পরিত্যাগ করা। যদি তিনি উন্নতমানের কাপড়-চোপর পরতে চান তাতে দোষের কিছু নেই। কেননা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনÑ 
قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ قُلْ هِيَ لِلَّذِينَ آمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا خَالِصَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ.
‘হে নবী! আপনি বলে দিন, আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য যে সাজ-সজ্জা ও পবিত্র খাদ্যবস্তুসমূহ সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে? আপনি বলুন! এ সকল নিয়ামত আসলে পার্থিবজীবনে মু’মিনদের জন্যই এবং কিয়ামতের দিন শুধু তাদের জন্যই হবে। এভাবে আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করি যারা জ্ঞান রাখে তাদের জন্য”। [٣٢: سورة الأعراف]
আসলে যিনি মুফতী তিনি হলেন একজন বিচারকের সমতুল্য। তাই তাঁর এমন পোশাক পরিধান করা উচিত, যাতে সাধারণ লোকের মাঝে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হয়। [٢٨١:الاحكام في تمييز الفتوىٰ عن الأحكام للإمام أبي عباس القرافي ]
খ. তাঁর উচিত কথাবার্তা এবং কাজকর্মে উন্নত মানসিকতার অধিকারী হওয়া। কেননা তিনি হলেন মানুষের জন্য একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। সুতরাং বক্তব্যের মতো তার কথা-বার্তায়ও গাম্ভীর্য থাকতে হবে। কেননা তার কথা-বার্তার বিশেষ গুরুত্ব থাকে। 
গ. তাঁর উচিত হবে চিন্তা-ভাবনাকে পরিশুদ্ধ করে নেয়া। বিশুদ্ধ নিয়তের সাথে ফতোয়া প্রদান করা। কেননা তাঁকে মনে রাখতে হবে তিনি রাসূল সা.-এর প্রতিনিধি হিসেবে আল্লাহর বিধান বর্ণনা করছেন। কুরআন এবং হাদীসকে তিনি সমুন্নত করার কাজে নিয়োজিত আছেন। মানুষের অবস্থানসমূহকে তিনি সংশোধন করছেন। অতএব এক্ষেত্রে তাঁকে আল্লাহর সাহায্য ও ফতোয়া প্রদানের তাওফিক কামনা করতে হবে। ফতোয়া প্রদানের মাধ্যমে মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন ও উচ্চাসনে আসীন হওয়ার বাসনা পরিহার করতে হবে। বিশেষকরে তিনিই কেবল সঠিক ফতোয়া দিচ্ছেন আর অন্যরা ভুল ফতোয়া দিচ্ছেনÑ এ ধরনের মন মানসিকতা সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে চলতে হবে। [١١: صفة الفتوي والمفتي والمستفتي]
ঘ. তিনি যা ফতোয়া দিচ্ছেন তদনুযায়ী তাকে আমল করতে হবে। অর্থাৎ তিনি যে সকল কল্যাণমূলক কাজের ফতোয়া দেন তাঁকে সে অনুযায়ী চলতে হবে এবং যা কিছু থেকে মানুষকে বিরত থাকতে বলেন সর্বাগ্রে তাকেই সেসব কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। তা হলেই কেবল তাঁর কথা এবং কাজের মধ্যে সামঞ্জস্যতা পাওয়া যাবে। আর যদি তা না হয়, তাহলে তার আমল তার বক্তব্যকে অস্বীকার করবে। ফলে মানুষ তার বক্তব্যে নয় বরং কাজের দ্বারাই প্রভাবিত হবে।
    [الموافقات في أصول الشريعة للامام أبي اسحاق الشاطبي   ٣ : ٢٠٢]
ঙ. অত্যধিক রাগ, আনন্দ, পিপাসা, ক্ষুধা, অসুস্থতা, অসহ্যগরম, প্রচণ্ড শীত প্রভৃতি অবস্থাসমূহে ফতোয়া প্রদানে বিরত থাকা একান্ত কর্তব্য। কেননা উপরোক্ত অবস্থাসমূহ সঠিক চিন্তা-ভাবনা ও বিশুদ্ধ বক্তব্য প্রদানে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।  [٤:٢٢٧ إعلام الموقعين]
তাছাড়া নবিয়ে করীম সা. বলেছেনÑلا يقضين حكم بين اثنين وهو غضبان  কোনো বিচারক যেন দু’জনের মাঝে ফায়সালা না করে যখন সে বিক্ষুদ্ধ অবস্থায় থাকে। 
[١٣٣٤ : صحيح مسلم رقم الحديث] 
অতএব তিনি যদি উপরোক্ত কোনো অবস্থার মধ্যে থাকেন, তাহলে ফতোয়া প্রদান থেকে বিরত থাকবেন, যতোক্ষণ না স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন। তবে তিনি যদি মনে করেন উপরোল্লিখিত অবস্থাসমূহে তাঁর সঠিক ফতোয়া প্রদানে কোনো সমস্যা হবে না, তা হলে তার পক্ষে ফতোয়া প্রদান বৈধ রয়েছে। [٤:١٤٠ الشرح الكبير للإمام الدسوقي]
এ ক্ষেত্রে মালিকি মাযহাবের ইমামগণ শর্ত দেন, তিনি যেন আসল চিন্তাধারার বাইরে চলে না যান। যদি তা-ই হয় তা হলে তাঁর পক্ষে ফতোয়া প্রদান বৈধ হবে না।
 [١٤٠Ñ٤: الشرح الكبير للإمام الدسوقي]
চ. যদি তাঁর আশেপাশে বিজ্ঞ আলেমে দ্বীন থাকেন যার উপর পূর্ণ আস্থা রাখা যায়, তা হলে তার সাথে পরামর্শ করে ফতোয়া দেয়া উচিত। নিজেকে বড় মনে করে অন্যের সাথে পরামর্শ না করা ঠিক হবে না। কেননা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনÑ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ  ‘তাদের সাথে পরামর্শ করুন!’ খুলাফায়ে রাশেদীন পরস্পর পরামর্শ করতেন। বিশেষকরে হযরত উমর রা. অসংখ্যবার সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামশ করেছেন।  [٢٥٦ : ٤  إعلام الموقعين]
ছ. ফতোয়াপ্রার্থীর অবস্থার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। অনেক ফতোয়াপ্রার্থীর জ্ঞান কম হয়ে থাকে। ধৈর্যের সাথে তার প্রশ্ন শুনে তাকে এর উত্তর বুঝিয়ে দিতে হবে।
[ ٤٧:للنووي ١ المجموع]
যদি মুফতী সাহেব মনে করেন, প্রশ্নের উত্তরে অতিরিক্ত কিছু বলা প্রয়োজন, যদিও তা প্রশ্নকর্তা তার প্রশ্নে উল্লেখ করনেনি, তথাপি তিনি তা বলতে পারেন।  যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَسْأَلُونَكَ مَاذَايُنْفِقُونَ قُلْ مَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ خَيْرٍ فَلِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ Ñ 
‘তারা আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে কী তারা ব্যয় করবে? বলে দিন! ভালো যে বস্তুই তোমরা ব্যয় করবে তা হবে পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয় ও আপনজনদের জন্য, এতিম ও অনাথদের জন্য, অসহায়দের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। আর তোমরা যে কোনো সৎকাজ করবে নিঃসন্দেহে তা অত্যন্ত ভালোভাবেই আল্লাহর জানা রয়েছে।’ [٢١٥ : سورة البقرة] 
উপরোক্ত আয়াতে সাহাবায়ে কেরাম রা. রাসূল সা.-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন তারা কী খরচ করবেন সে সম্পর্কে; কিন্তু প্রত্যুত্তরে খরচের খাতও বর্ণনা করেন। কেননা কী খরচ করবে তার চেয়ে কোথায় খরচ করবে সে প্রশ্নও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। [ ٤٧:إعلام الموقعين١]
একবার কতিপয় সাহাবী নবী সা.-কে সমুদ্রের পানি দিয়ে অজু করার প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,   هو الطهور ماؤه و الحل ميتتة    ‘সমুদ্রের পানি পবিত্র, তার মৃত প্রাণী হালাল।’ 
নবী সা.-এর নিকট প্রাণী সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করেননি তা সত্ত্বেও নবী সা. প্রয়োজন মনে করে তারও উত্তর দিলেন। সুতরাং প্রশ্ন না চাওয়া হলেও মুফতী সাহেব যদি মনে করেন অতিরিক্ত উত্তর দিলে প্রশ্নকারীর উপকার হবে তাহলে তিনি তা করতে পারেন।
জ. যখন লিখিত আকারে মুফতীর কাছে কোন ফতোয়া চাওয়া হয়, তখন মুফতী প্রথমতঃ প্রশ্নটি ধীরস্থিরভাবে পড়ে লক্ষ্য করে দেখবেন যে, প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার যোগ্য কিনা কিংবা এর উত্তর দেওয়া হলে কোন ভুল বুঝাবুঝি বা কোন অবান্তর ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টির আশংকা আছে কিনা? যদি প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া অযোগ্য বলে বিবেচিত হয় অথবা এর উত্তর দেওয়া হয়ে ভুল বুঝাবুঝি বা ফিতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টির ভয় থাকে, তবে এর উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। আর যদি প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার যোগ্য হয় তবে প্রশ্নের সাথে সমতা রক্ষা করে যথাযথভাবে ফতোয়া প্রদান করবেন। [٦٣٩-٦٣٧ المصباح]
ঝ. যদি এমন বিষয়ে ফতোয়া চাওয়া হয় যা সংঘটিত হয়নি, তা হলে তার উত্তর দেয়ার প্রয়োজন নেই। যাতে ফতোয়াপ্রার্থী এ কথা বুঝে নিতে পারে যে, অযথা ফতোয়া চাওয়া সঠিক নয়। তা ছাড়া নবিয়ে করীম সা. ইরশাদ করেনÑ
ان الله كره لكم ثلاثا :قيل وقال’ واضاعة المال ’ وكثرة السوال
নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য তিনটি জিনিস অপছন্দ করেন। ১. অযথা কথাবার্তা বলা ২. সম্পদ নষ্ট করা ৩. অতিরিক্ত প্রশ্ন করা।  [١٣٤١Ñصحيح مسلم رقم الحديث]
ফতোয়াপ্রার্থীর করণীয়
      ১. কোনো মুসলিম যখন কোনো দ্বীনি সমস্যার সম্মুখীন হন তখন তার উচিত হবে কোনো নির্ভরযোগ্য মুফতীর শরণাপন্ন হওয়া। যদি তার নিজ শহরে নির্ভরযোগ্য মুফতী পাওয়া না যায়, তাহলে অন্য কোনো শহরে তালাশ করতে হবে। কেননা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
‘যদি তোমরা না জানো তা হলে জ্ঞানী লোকদের জিজ্ঞাসা করো।’ [٤٣ سورة النحل :]
২. ফতোয়াপ্রার্থীর উচিত হবে ফতোয়া প্রদানকারীর সাথে আদব রক্ষা করা, তাকে সম্মান করা, তার জ্ঞানের মর্যাদা দেয়া। কেননা তিনি তাকে রাস্তা দেখাচ্ছেন।
 ]شرح المنتهي للخطيب البغدادي ٣:٤٥٦ [
৩. ক্রোধ, অসন্তোষ, পেরেশানি ইত্যাদির সময় ফতোয়া না চাওয়া। 
]شرح المنتهي للخطيب البغدادي  ٣:٤٥٦[
৪. অধিক প্রশ্ন না করা। যা সংঘটিত হয়নি সে সম্পর্কে প্রশ্ন না করা। দ্বীনি কোনো উপকার নেই, এমন কোনো বিষয়ে ফতোয়া না চাওয়া। ইবাদত বন্দেগির কাঠিন্য এবং কৌশল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা না করা। একগুয়েমি বা জিদের বশবর্তী হয়ে অথবা ঝগড়া-বিবাদে জয়ী হবার মানসে প্রশ্ন না করা। [٣١٩:٣ الموافقات في اصول الشريعة للامام ابي اسحاق الشاطبي ]
৫. লিখিতভাবে ফতোয়া চাইতে হবে। প্রার্থী লিখতে না জানলে অন্যের মাধ্যমে লিখিয়ে নিতে হবে। 
৬. বড় সাইজের কাগজে সুন্দর ও স্পষ্ট অক্ষরে প্রশ্ন লিখতে হবে। যেন ফতোয়া একই কাগজেই উপস্থাপন করা যায়। 
ফতোয়া লিখার নিয়মাবলি 
* বিসল্লিাহির রাহমানির রাহীম এবং হামদ ও সানা দিয়ে ফতোয়া লিখা শুরু করা উচিত। কেননা নবিয়ে করীম সা. বলেছেনÑ
كل امر ذي بال لم يبدأ ببسم الله فهو أقطع.
‘কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যদি বিসমিল্লাহ দ্বারা শুরু না করা হয়, তা হলে তা অপূর্ণাঙ্গ থাকে। [سنن ابن ماجة رقم الحديث١٨٩٤  ]
* ফতোয়া প্রদানকারীর উচিত, সুন্দর ও স্পষ্টভাবে ফতোয়া লিপিবদ্ধ করা। এতে ফতোয়ার ভাষা ও উদ্দেশ্য বুঝতে সহজ হবে এবং অস্পষ্টতা ও জটিলতামুক্ত থাকবে। প্রয়োজনে কাগজের দুই পাশে পার্শ্বটীকা লেখার জন্য খালি রাখতে হবে। বর্ণিত আছে যে, ইমাম আবু হানীফা রহ. এক লেখককে অস্পষ্ট ও জটিল ভাষায় লিখতে দেখে বলেন, ‘এভাবে লিখো না। যদি এভাবে লিখো তাহলে বেঁচে থাকলে লজ্জিত হবে, আর মরে গেলে নিন্দিত হবে।’  [٦٤٧ :المصباح ]
* ফতোয়া প্রদানকারীর উচিত, প্রশ্নের কাগজেই জবাব লিপিবদ্ধ করা। যতোটুকু সম্ভব ভিন্ন কাগজ ব্যবহার না করা। তা না হলে অন্য কোনো প্রশ্ন ঢুকিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। [٣٦ :صفة الفتوى والمفتي ]
* ফতোয়া এমনভাবে স্পষ্টভাষায় লিখতে হবে যেন অন্য কিছু বুঝার সুযোগ না থাকে। সারসংক্ষেপ ভাষায় ফতোয়া লেখা উচিত নয়। এতে ফতোয়াপ্রার্থী দিশেহারা হতে পারে। [١٧٧:٤ إعلام الموقعين]
ফতোয়ার দলীল কুরআনের আয়াত হোক অথবা হাদীস কিংবা অন্যকিছু হোক, তা স্পষ্টভাবে সুন্দর করে উল্লেখ করতে হবে। এতে ফতোয়ার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। [١٦:٤ إعلام الموقعين]
* সংক্ষিপ্তাকারে ফতোয়ার জবাব লিপিবদ্ধ করা উচিত। বিনা প্রয়োজনে বিস্তারিত বর্ণনা পরিহার করা দরকার। কেননা ফতোয়া হলো নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তরপ্রদান। এটা কোনো ওয়াজ-তালীম বা রচনা নয়।   [٦٠ :صفة الفتوى والمفتي ]
* ফতোয়া লিখা শেষে والله اعلم  লিখা উচিত। এ ব্যাপারে আল-বাহরুর রায়েক গ্রন্থের লেখক আল্লামা ইবনে নুজায়িম রহ. বলেন, ‘যদি কোনো ফিকহী মাসআলার উত্তর লিখা হয় তাহলে তার শেষে  والله اعلمআর যদি আকায়িদের কোনো প্রশ্নের উত্তর লিখা হয় তবেوالله الموفق   লেখা উচিত। [٢٦٩:البحر الرائق٦]
* সবশেষে যেদিন ফতোয়া চূড়ান্তভাবে লিখার কাজ সমাপ্ত হয় সেদিন মুফতী সাহেব তার দস্তখত, সম্ভব হলে প্রতিষ্ঠানের সিলমোহরসহ সেদিনটির তারিখও লিখে দিবেন।
 [اهمية الفتوي و تعريفه و حاجته,  أصول الإفتاء للشيخ محمد تقي عثماني ١٧٨ ]
ফতোয়া ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। কেননা খোদ আল্লাহ তাআলা ফতোয়া প্রদান করেছেন। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-ও আল্লাহর নির্দেশে একাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সা.-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সাহাবায়ে কেরাম ফতোয়া প্রদান করে গেছেন। এভাবে সাহাবায়ে কেরামের পর তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, আয়িম্মায়ে মুজতাহিদীনসহ সর্বযুগে একাজ অব্যাহত ছিলো। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর সকল মুসলিম রাষ্ট্রে এবিধান চালু আছে। ভবিষ্যতেও চালু থাকবে। একাজ বন্ধ করার সাধ্য কারো নেই। 
যদি কোনো রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে ফতোয়া প্রদানের ব্যবস্থা চালু থাকে তাহলে সেটা তো ভালো কথা। অন্যথায় দেশের বিদগ্ধ উলামায়ে কেরামকেই এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। এতে কোনোপ্রকার শিথিলতা অবলম্বন করার অবকাশ নেই। রাষ্ট্র যদি এটা বন্ধ করে দেয়ার উদ্যোগী হয় তাহলে আন্দোলন করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী ও নৈতিক দায়িত্ব। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাঁর বিধান বুঝার এবং তা মেনে চলার তওফিক দান করুন ।