মুফতী মুহাম্মদ আতিকুর রহমান
ছাত্র, ইফতা বিভাগ, মা‘হাদুল ইকতিসাদ ওয়াল ফিকহিল ইসলামী
ইসলামে ফতোয়া প্রদানের যেমন গুরুত্ব ও মর্যাদা রয়েছে তেমনি ঝুঁকিও রয়েছে অপরিসীম। কেননা ফতোয়া প্রদানকারী প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে দ্বীন সংক্রান্ত বিষয়াদি বর্ণনা করে থাকেন, হালাল-হারাম ব্যক্ত করেন। তাই আমাদের পূর্বসূরীরা সহজে ফতোয়া প্রদানের কাজে জড়িত হতে চাইতেন না। আবার ইলম গোপন করার আশঙ্কা ও জবাবদিহিতার ভয়ে দূরেও থাকতে পারতেন না।
ফতোয়া যে কারো পক্ষে প্রদান করা সম্ভব নয়। কুরআন, হাদীস ও ফিকহে ইসলামীর যথেষ্ট জ্ঞান না থাকলে এ কাজ করা যায় না। তাছাড়া এ শাস্ত্রের ইমামগণ আরো কিছু শর্ত ও নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করেছেন যা একজন মুফতীকে অর্জন করতে হয়। বক্ষমান প্রবন্ধে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
ফতোয়া প্রদানের যোগ্যতা
যিনি ফতোয়া প্রদান করেন বা ফতোয়া প্রদানের কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাঁকে মুফতী বলা হয়। মুফতী হওয়ার জন্য অনেকগুলো শর্ত রয়েছে। ফিকাহ বিশারদগণ এসব শর্ত তাদের কিতাবাদিতে নির্ধারণ করেছেন। সেখান থেকে শর্তগুলো নিম্নে প্রদত্ত হলো।
প্রথম শর্ত : মুফতীকে মুসলিম হতে হবে। অমুসলিমের ফতোয়া প্রদান বৈধ নয়।
দ্বিতীয় শর্ত : তার (আকল) বিবেক-বুদ্ধি থাকতে হবে। পাগল বা মাতালের ফতোয়া প্রদান বৈধ নয়।
তৃতীয় শর্ত : বালেগ হতে হবে। না-বালেগের ফতোয়া গ্রহনযোগ্য নয়।
চতুর্থ শর্ত : মুফতীকে ন্যায়পরায়ণ, সুবিচারক এবং পুণ্যবান হতে হবে। ফাসেক পাপাচারীর ফতোয়া প্রদান বৈধ নয়।
] مقدمة شرح المهذب للنووي ١ : ٦٩ عن المصباح للمفتى كمال الدين احمدالراشدى :٦١٧[
পঞ্চম শর্ত : ফতোয়া প্রদানকারীকে খুব সচেতন ও বিচক্ষণ হতে হবে। মানুষের বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। কেননা কিছু লোক এমন আছে, যারা প্রতারণা ও ধোঁকার মাধ্যমে কথা পাল্টিয়ে দেয়াসহ ভ্রান্ত একটি বিষয়কে সত্য ও সঠিকের আবরণে উপস্থাপন করার যথেষ্ট যোগ্যতা রাখে। ফলে এ ক্ষেত্রে একজন মুফতীর অমনোযোগিতা ও অসচেতনতা বিরাট বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, ‘মুফতীর জন্য অবশ্যকর্তব্য হলো, মানুষের ধোঁকা, প্রতারণা এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হওয়া। তা না হলে তিনি যেমন নিজে পথভ্রষ্ট হবেন তেমনি অন্যকেও পথভ্রষ্ট করবেন। একজন মুফতী যদি মানুষের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত না হন, তাহলে তার নিকট জালিম মজলুমের কিংবা মজলুম জালিমের আকৃতিতে প্রকাশ পেতে পারে। قيم الجوزية ٤ :٢٠٥] . إعلام الموقعين عن رب العالمين للامام ابن ]
শহরবাসীদের বিভিন্ন আচার আচরণ, মতভেদ ও সামাজিক নিয়ম নীতির প্রতি সচেতন থাকাও একান্ত প্রয়োজন। ওলামায়ে কেরাম বলেন, من لم يعرف اهل زمانه فهو جاهل ‘যেব্যক্তি তার যুগের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল নয় সে মূর্খ।’
এবিষয়ে কতিপয় উলামায়ে কেরাম সতর্কতামূলক অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, ‘মুফতী হতে হলে তাকে অবশ্যই ফতোয়া প্রার্থীর ভাষা ও শব্দচয়ন সম্পর্কে পারদর্শী হতে হবে। যাতে তিনি উল্টো কোনোকিছু বুঝে ফতোয়া না দেন। বিশেষ করে কসম ও স্বীকারোক্তির ভাষার ক্ষেত্রে।[ المجموع من شرح المهذب ١:١٤]
ষষ্ঠ শর্ত : মুফতীর এমন যোগ্যতা (মালাকাহ) থাকতে হবে যাতে তিনি অতীত ও বর্তমান লিখিত দ্বীনি কিতাবসমূহ বুঝতে পারেন এবং এর থেকে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে ফতোয়াপ্রদানে সক্ষম হন।
উল্লেখ্য যে, ফতোয়া প্রদানের দায়িত্ব পালনের জন্য শুধু পাঠ্যতালিকাভূক্ত ফিকহের কিতাব পড়াই যথেষ্ট নয়, বরং ফতোয়া প্রদানের নিয়মনীতি সম্পর্কিত কিতাবাদি অধ্যয়ন করা, প্রচলিত প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য ফতোয়ার কিতাবসমূহ পাঠ করা এবং কোনো অভিজ্ঞ মুফতীর সাহচর্যে থেকে তার পথ-নির্দেশনা লাভ করা মুফতীর জন্য একান্ত প্রয়োজন।
এমনকি শুধু অভিজ্ঞ মুফতীর কাছে শিক্ষাগ্রহণ করলেই ফতোয়া প্রদানের দায়িত্ব পালনে সফলতা লাভ করা যায় না। যতোক্ষণ নিজের মধ্যে এমন দক্ষতা ও নৈপুণ্য সৃষ্টি না হয়, যা দ্বারা সে উসূলে আহকাম, ইল্লত ও মাসআলার কাওয়াইদ নির্দ্বিধায় অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। ফতোয়ার কাজে সার্বক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট থাকা ও ফতেয়ার বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা দ্বারাই এ গুণ অর্জিত হতে পারে।
[ملخص من المصباح ٣٤٧-٣٥٧ و آداب المفتي ٩٧-١٠٤]
সপ্তম শর্ত : মুফতীর জন্য আরেকটি শর্ত হলো, তাকে কোনো অভিজ্ঞ মুফতীর কাছ থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত হতে হবে। যেমন, ইমাম মালিক রহ. বলেন, ‘আমি ততোক্ষণ পর্যন্ত ফতোয়া প্রদানের কাজে নিয়োজিত হইনি যতোক্ষণ না আমাকে সত্তুরজন আলেম ফতোয়া প্রদানের অনুমতি প্রদান করেছে।
[المجموع من شرح المهذب ١ : ٦٩]
পরিশেষে, মুফতী হওয়ার জন্য স্বাধীন পুরুষ, কানে শোনা, চোখে দেখা, কথা বলতে পারা জরুরি নয়। ক্রীতদাস, নারী, বধির, অন্ধ ও বোবাও ফতোয়া দিতে পারেন যদি তারা লিখতে পারেন অথবা তাদের ইশারা ইঙ্গিত বুঝা যায়।
[مقدمة شرح المهذب ١:٦٩]
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. উল্লেখ করেন, ‘যিনি মুফতী হবেন অবশ্যই তাকে পাঁচটি গুণের অধিকারী হতে হবে। ১. তার বিশুদ্ধ নিয়ত থাকতে হবে। যদি নিয়াত ঠিক না হয় তাহলে সেখানে নূর আসে না। ২. তার ইলম, সহিষ্ণুতা, গাম্ভীর্য ও স্থিরতা থাকতে হবে। ৩. ইলমের মধ্যে গভীরতা ও শক্ত ভিত্তি থাকতে হবে। ৪. তার যথেষ্ট যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকতে হবে, যাতে তিনি অন্যের সাহায্য ছাড়াই সমাধান দিতে পারেন। ৫. মানুষের অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত থাকতে হবে। কারণ যারা মানুষের অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞ, তারাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফতোয়া প্রদানে ভুল করেন।’ [مقدمة شرح المهذب ١:٦٩]
ফতোয়া প্রদানের আদবসমূহ
যিনি ফতোয়া প্রদান করবেন অবশ্যই তাকে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। তাহলেই কেবল তার ফতোয়া গ্রহণযোগ্য হবে।
ক. যিনি মুফতী হবেন তাঁর উচিত হবে শরীয়তের বিধানসমূহের প্রতি লক্ষ রেখে পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করা। তা সুন্দর রাখা এবং পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার উপর গুরুত্ব দেয়া। রেশমী কাপড়, স্বর্ণ এবং যেসকল পোশাকে অমুসলিমদের নিদর্শন রয়েছে তা পরিত্যাগ করা। যদি তিনি উন্নতমানের কাপড়-চোপর পরতে চান তাতে দোষের কিছু নেই। কেননা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনÑ
قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ قُلْ هِيَ لِلَّذِينَ آمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا خَالِصَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ.
‘হে নবী! আপনি বলে দিন, আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য যে সাজ-সজ্জা ও পবিত্র খাদ্যবস্তুসমূহ সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে? আপনি বলুন! এ সকল নিয়ামত আসলে পার্থিবজীবনে মু’মিনদের জন্যই এবং কিয়ামতের দিন শুধু তাদের জন্যই হবে। এভাবে আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করি যারা জ্ঞান রাখে তাদের জন্য”। [٣٢: سورة الأعراف]
আসলে যিনি মুফতী তিনি হলেন একজন বিচারকের সমতুল্য। তাই তাঁর এমন পোশাক পরিধান করা উচিত, যাতে সাধারণ লোকের মাঝে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হয়। [٢٨١:الاحكام في تمييز الفتوىٰ عن الأحكام للإمام أبي عباس القرافي ]
খ. তাঁর উচিত কথাবার্তা এবং কাজকর্মে উন্নত মানসিকতার অধিকারী হওয়া। কেননা তিনি হলেন মানুষের জন্য একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। সুতরাং বক্তব্যের মতো তার কথা-বার্তায়ও গাম্ভীর্য থাকতে হবে। কেননা তার কথা-বার্তার বিশেষ গুরুত্ব থাকে।
গ. তাঁর উচিত হবে চিন্তা-ভাবনাকে পরিশুদ্ধ করে নেয়া। বিশুদ্ধ নিয়তের সাথে ফতোয়া প্রদান করা। কেননা তাঁকে মনে রাখতে হবে তিনি রাসূল সা.-এর প্রতিনিধি হিসেবে আল্লাহর বিধান বর্ণনা করছেন। কুরআন এবং হাদীসকে তিনি সমুন্নত করার কাজে নিয়োজিত আছেন। মানুষের অবস্থানসমূহকে তিনি সংশোধন করছেন। অতএব এক্ষেত্রে তাঁকে আল্লাহর সাহায্য ও ফতোয়া প্রদানের তাওফিক কামনা করতে হবে। ফতোয়া প্রদানের মাধ্যমে মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন ও উচ্চাসনে আসীন হওয়ার বাসনা পরিহার করতে হবে। বিশেষকরে তিনিই কেবল সঠিক ফতোয়া দিচ্ছেন আর অন্যরা ভুল ফতোয়া দিচ্ছেনÑ এ ধরনের মন মানসিকতা সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে চলতে হবে। [١١: صفة الفتوي والمفتي والمستفتي]
ঘ. তিনি যা ফতোয়া দিচ্ছেন তদনুযায়ী তাকে আমল করতে হবে। অর্থাৎ তিনি যে সকল কল্যাণমূলক কাজের ফতোয়া দেন তাঁকে সে অনুযায়ী চলতে হবে এবং যা কিছু থেকে মানুষকে বিরত থাকতে বলেন সর্বাগ্রে তাকেই সেসব কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। তা হলেই কেবল তাঁর কথা এবং কাজের মধ্যে সামঞ্জস্যতা পাওয়া যাবে। আর যদি তা না হয়, তাহলে তার আমল তার বক্তব্যকে অস্বীকার করবে। ফলে মানুষ তার বক্তব্যে নয় বরং কাজের দ্বারাই প্রভাবিত হবে।
[الموافقات في أصول الشريعة للامام أبي اسحاق الشاطبي ٣ : ٢٠٢]
ঙ. অত্যধিক রাগ, আনন্দ, পিপাসা, ক্ষুধা, অসুস্থতা, অসহ্যগরম, প্রচণ্ড শীত প্রভৃতি অবস্থাসমূহে ফতোয়া প্রদানে বিরত থাকা একান্ত কর্তব্য। কেননা উপরোক্ত অবস্থাসমূহ সঠিক চিন্তা-ভাবনা ও বিশুদ্ধ বক্তব্য প্রদানে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। [٤:٢٢٧ إعلام الموقعين]
তাছাড়া নবিয়ে করীম সা. বলেছেনÑلا يقضين حكم بين اثنين وهو غضبان কোনো বিচারক যেন দু’জনের মাঝে ফায়সালা না করে যখন সে বিক্ষুদ্ধ অবস্থায় থাকে।
[١٣٣٤ : صحيح مسلم رقم الحديث]
অতএব তিনি যদি উপরোক্ত কোনো অবস্থার মধ্যে থাকেন, তাহলে ফতোয়া প্রদান থেকে বিরত থাকবেন, যতোক্ষণ না স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন। তবে তিনি যদি মনে করেন উপরোল্লিখিত অবস্থাসমূহে তাঁর সঠিক ফতোয়া প্রদানে কোনো সমস্যা হবে না, তা হলে তার পক্ষে ফতোয়া প্রদান বৈধ রয়েছে। [٤:١٤٠ الشرح الكبير للإمام الدسوقي]
এ ক্ষেত্রে মালিকি মাযহাবের ইমামগণ শর্ত দেন, তিনি যেন আসল চিন্তাধারার বাইরে চলে না যান। যদি তা-ই হয় তা হলে তাঁর পক্ষে ফতোয়া প্রদান বৈধ হবে না।
[١٤٠Ñ٤: الشرح الكبير للإمام الدسوقي]
চ. যদি তাঁর আশেপাশে বিজ্ঞ আলেমে দ্বীন থাকেন যার উপর পূর্ণ আস্থা রাখা যায়, তা হলে তার সাথে পরামর্শ করে ফতোয়া দেয়া উচিত। নিজেকে বড় মনে করে অন্যের সাথে পরামর্শ না করা ঠিক হবে না। কেননা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনÑ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ ‘তাদের সাথে পরামর্শ করুন!’ খুলাফায়ে রাশেদীন পরস্পর পরামর্শ করতেন। বিশেষকরে হযরত উমর রা. অসংখ্যবার সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামশ করেছেন। [٢٥٦ : ٤ إعلام الموقعين]
ছ. ফতোয়াপ্রার্থীর অবস্থার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। অনেক ফতোয়াপ্রার্থীর জ্ঞান কম হয়ে থাকে। ধৈর্যের সাথে তার প্রশ্ন শুনে তাকে এর উত্তর বুঝিয়ে দিতে হবে।
[ ٤٧:للنووي ١ المجموع]
যদি মুফতী সাহেব মনে করেন, প্রশ্নের উত্তরে অতিরিক্ত কিছু বলা প্রয়োজন, যদিও তা প্রশ্নকর্তা তার প্রশ্নে উল্লেখ করনেনি, তথাপি তিনি তা বলতে পারেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَسْأَلُونَكَ مَاذَايُنْفِقُونَ قُلْ مَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ خَيْرٍ فَلِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ Ñ
‘তারা আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে কী তারা ব্যয় করবে? বলে দিন! ভালো যে বস্তুই তোমরা ব্যয় করবে তা হবে পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয় ও আপনজনদের জন্য, এতিম ও অনাথদের জন্য, অসহায়দের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। আর তোমরা যে কোনো সৎকাজ করবে নিঃসন্দেহে তা অত্যন্ত ভালোভাবেই আল্লাহর জানা রয়েছে।’ [٢١٥ : سورة البقرة]
উপরোক্ত আয়াতে সাহাবায়ে কেরাম রা. রাসূল সা.-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন তারা কী খরচ করবেন সে সম্পর্কে; কিন্তু প্রত্যুত্তরে খরচের খাতও বর্ণনা করেন। কেননা কী খরচ করবে তার চেয়ে কোথায় খরচ করবে সে প্রশ্নও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। [ ٤٧:إعلام الموقعين١]
একবার কতিপয় সাহাবী নবী সা.-কে সমুদ্রের পানি দিয়ে অজু করার প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, هو الطهور ماؤه و الحل ميتتة ‘সমুদ্রের পানি পবিত্র, তার মৃত প্রাণী হালাল।’
নবী সা.-এর নিকট প্রাণী সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করেননি তা সত্ত্বেও নবী সা. প্রয়োজন মনে করে তারও উত্তর দিলেন। সুতরাং প্রশ্ন না চাওয়া হলেও মুফতী সাহেব যদি মনে করেন অতিরিক্ত উত্তর দিলে প্রশ্নকারীর উপকার হবে তাহলে তিনি তা করতে পারেন।
জ. যখন লিখিত আকারে মুফতীর কাছে কোন ফতোয়া চাওয়া হয়, তখন মুফতী প্রথমতঃ প্রশ্নটি ধীরস্থিরভাবে পড়ে লক্ষ্য করে দেখবেন যে, প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার যোগ্য কিনা কিংবা এর উত্তর দেওয়া হলে কোন ভুল বুঝাবুঝি বা কোন অবান্তর ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টির আশংকা আছে কিনা? যদি প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া অযোগ্য বলে বিবেচিত হয় অথবা এর উত্তর দেওয়া হয়ে ভুল বুঝাবুঝি বা ফিতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টির ভয় থাকে, তবে এর উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। আর যদি প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার যোগ্য হয় তবে প্রশ্নের সাথে সমতা রক্ষা করে যথাযথভাবে ফতোয়া প্রদান করবেন। [٦٣٩-٦٣٧ المصباح]
ঝ. যদি এমন বিষয়ে ফতোয়া চাওয়া হয় যা সংঘটিত হয়নি, তা হলে তার উত্তর দেয়ার প্রয়োজন নেই। যাতে ফতোয়াপ্রার্থী এ কথা বুঝে নিতে পারে যে, অযথা ফতোয়া চাওয়া সঠিক নয়। তা ছাড়া নবিয়ে করীম সা. ইরশাদ করেনÑ
ان الله كره لكم ثلاثا :قيل وقال’ واضاعة المال ’ وكثرة السوال
নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য তিনটি জিনিস অপছন্দ করেন। ১. অযথা কথাবার্তা বলা ২. সম্পদ নষ্ট করা ৩. অতিরিক্ত প্রশ্ন করা। [١٣٤١Ñصحيح مسلم رقم الحديث]
ফতোয়াপ্রার্থীর করণীয়
১. কোনো মুসলিম যখন কোনো দ্বীনি সমস্যার সম্মুখীন হন তখন তার উচিত হবে কোনো নির্ভরযোগ্য মুফতীর শরণাপন্ন হওয়া। যদি তার নিজ শহরে নির্ভরযোগ্য মুফতী পাওয়া না যায়, তাহলে অন্য কোনো শহরে তালাশ করতে হবে। কেননা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
‘যদি তোমরা না জানো তা হলে জ্ঞানী লোকদের জিজ্ঞাসা করো।’ [٤٣ سورة النحل :]
২. ফতোয়াপ্রার্থীর উচিত হবে ফতোয়া প্রদানকারীর সাথে আদব রক্ষা করা, তাকে সম্মান করা, তার জ্ঞানের মর্যাদা দেয়া। কেননা তিনি তাকে রাস্তা দেখাচ্ছেন।
]شرح المنتهي للخطيب البغدادي ٣:٤٥٦ [
৩. ক্রোধ, অসন্তোষ, পেরেশানি ইত্যাদির সময় ফতোয়া না চাওয়া।
]شرح المنتهي للخطيب البغدادي ٣:٤٥٦[
৪. অধিক প্রশ্ন না করা। যা সংঘটিত হয়নি সে সম্পর্কে প্রশ্ন না করা। দ্বীনি কোনো উপকার নেই, এমন কোনো বিষয়ে ফতোয়া না চাওয়া। ইবাদত বন্দেগির কাঠিন্য এবং কৌশল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা না করা। একগুয়েমি বা জিদের বশবর্তী হয়ে অথবা ঝগড়া-বিবাদে জয়ী হবার মানসে প্রশ্ন না করা। [٣١٩:٣ الموافقات في اصول الشريعة للامام ابي اسحاق الشاطبي ]
৫. লিখিতভাবে ফতোয়া চাইতে হবে। প্রার্থী লিখতে না জানলে অন্যের মাধ্যমে লিখিয়ে নিতে হবে।
৬. বড় সাইজের কাগজে সুন্দর ও স্পষ্ট অক্ষরে প্রশ্ন লিখতে হবে। যেন ফতোয়া একই কাগজেই উপস্থাপন করা যায়।
ফতোয়া লিখার নিয়মাবলি
* বিসল্লিাহির রাহমানির রাহীম এবং হামদ ও সানা দিয়ে ফতোয়া লিখা শুরু করা উচিত। কেননা নবিয়ে করীম সা. বলেছেনÑ
كل امر ذي بال لم يبدأ ببسم الله فهو أقطع.
‘কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যদি বিসমিল্লাহ দ্বারা শুরু না করা হয়, তা হলে তা অপূর্ণাঙ্গ থাকে। [سنن ابن ماجة رقم الحديث١٨٩٤ ]
* ফতোয়া প্রদানকারীর উচিত, সুন্দর ও স্পষ্টভাবে ফতোয়া লিপিবদ্ধ করা। এতে ফতোয়ার ভাষা ও উদ্দেশ্য বুঝতে সহজ হবে এবং অস্পষ্টতা ও জটিলতামুক্ত থাকবে। প্রয়োজনে কাগজের দুই পাশে পার্শ্বটীকা লেখার জন্য খালি রাখতে হবে। বর্ণিত আছে যে, ইমাম আবু হানীফা রহ. এক লেখককে অস্পষ্ট ও জটিল ভাষায় লিখতে দেখে বলেন, ‘এভাবে লিখো না। যদি এভাবে লিখো তাহলে বেঁচে থাকলে লজ্জিত হবে, আর মরে গেলে নিন্দিত হবে।’ [٦٤٧ :المصباح ]
* ফতোয়া প্রদানকারীর উচিত, প্রশ্নের কাগজেই জবাব লিপিবদ্ধ করা। যতোটুকু সম্ভব ভিন্ন কাগজ ব্যবহার না করা। তা না হলে অন্য কোনো প্রশ্ন ঢুকিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। [٣٦ :صفة الفتوى والمفتي ]
* ফতোয়া এমনভাবে স্পষ্টভাষায় লিখতে হবে যেন অন্য কিছু বুঝার সুযোগ না থাকে। সারসংক্ষেপ ভাষায় ফতোয়া লেখা উচিত নয়। এতে ফতোয়াপ্রার্থী দিশেহারা হতে পারে। [١٧٧:٤ إعلام الموقعين]
ফতোয়ার দলীল কুরআনের আয়াত হোক অথবা হাদীস কিংবা অন্যকিছু হোক, তা স্পষ্টভাবে সুন্দর করে উল্লেখ করতে হবে। এতে ফতোয়ার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। [١٦:٤ إعلام الموقعين]
* সংক্ষিপ্তাকারে ফতোয়ার জবাব লিপিবদ্ধ করা উচিত। বিনা প্রয়োজনে বিস্তারিত বর্ণনা পরিহার করা দরকার। কেননা ফতোয়া হলো নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তরপ্রদান। এটা কোনো ওয়াজ-তালীম বা রচনা নয়। [٦٠ :صفة الفتوى والمفتي ]
* ফতোয়া লিখা শেষে والله اعلم লিখা উচিত। এ ব্যাপারে আল-বাহরুর রায়েক গ্রন্থের লেখক আল্লামা ইবনে নুজায়িম রহ. বলেন, ‘যদি কোনো ফিকহী মাসআলার উত্তর লিখা হয় তাহলে তার শেষে والله اعلمআর যদি আকায়িদের কোনো প্রশ্নের উত্তর লিখা হয় তবেوالله الموفق লেখা উচিত। [٢٦٩:البحر الرائق٦]
* সবশেষে যেদিন ফতোয়া চূড়ান্তভাবে লিখার কাজ সমাপ্ত হয় সেদিন মুফতী সাহেব তার দস্তখত, সম্ভব হলে প্রতিষ্ঠানের সিলমোহরসহ সেদিনটির তারিখও লিখে দিবেন।
[اهمية الفتوي و تعريفه و حاجته, أصول الإفتاء للشيخ محمد تقي عثماني ١٧٨ ]
ফতোয়া ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। কেননা খোদ আল্লাহ তাআলা ফতোয়া প্রদান করেছেন। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-ও আল্লাহর নির্দেশে একাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সা.-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সাহাবায়ে কেরাম ফতোয়া প্রদান করে গেছেন। এভাবে সাহাবায়ে কেরামের পর তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, আয়িম্মায়ে মুজতাহিদীনসহ সর্বযুগে একাজ অব্যাহত ছিলো। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর সকল মুসলিম রাষ্ট্রে এবিধান চালু আছে। ভবিষ্যতেও চালু থাকবে। একাজ বন্ধ করার সাধ্য কারো নেই। যদি কোনো রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে ফতোয়া প্রদানের ব্যবস্থা চালু থাকে তাহলে সেটা তো ভালো কথা। অন্যথায় দেশের বিদগ্ধ উলামায়ে কেরামকেই এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। এতে কোনোপ্রকার শিথিলতা অবলম্বন করার অবকাশ নেই। রাষ্ট্র যদি এটা বন্ধ করে দেয়ার উদ্যোগী হয় তাহলে আন্দোলন করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী ও নৈতিক দায়িত্ব। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাঁর বিধান বুঝার এবং তা মেনে চলার তওফিক দান করুন ।
ماشاءالله احسنت.
উত্তরমুছুন